
শীতের সকালের কুয়াশা তখনও কাটেনি। চট্টগ্রামের পটিয়ার বাথুয়া গ্রামের একটি রান্নাঘরে ব্যস্ত হাতে ছেলের জন্য পরোটা বানাচ্ছিলেন মা। কারণ আগের রাতেই ফোনে আবদার করেছিলেন বড় ছেলে নয়ন বলেছিল, ‘মা, সকালে বাড়ি আসছি, তোমার হাতের পরোটা খাব। পরোটা বানাও; আমি আসছি।’ কিন্তু পরদিন বাড়ির সীমানায় পৌঁছেও ঘরে ঢোকা হলো না তার; সর্বশেষ দুপুরে নয়ন ফিরলো লাশ হয়ে।
শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) সকালে পটিয়া উপজেলার জিরি ফকিরা মসজিদ এলাকায় এক মর্মান্তিক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তরুণ ব্যাংক কর্মচারী নয়ন ইসলাম। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, বাড়ির সীমানায় পৌঁছেও ঘরে ঢোকা হলো না তার। তার মোটর সাইকেলটি বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় পৌঁছালে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গাছে ধাক্কা লাগে। এতে ঘটনাস্থলেই নয়নের মৃত্যু হয়। আহত হন রবিউল আকবর নামে আরও একজন।
দুর্ঘটনায় নিহত নয়ন আশিয়া গ্রামের মজিবুর রহমানের ছেলে। আহত আকবরকে আশঙ্কাজনক হওয়ায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, পটিয়া উপজেলা আশিয়া ইউনিয়নের বাথুয়া গ্রামের মজিবুর রহমানের বড় ছেলে নয়ন ইসলাম পেশায় ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির চকবাজার শাখার মেসেঞ্জার বা পিয়ন। সংসারের হাল ধরা এই তরুণ বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করে বন্ধু রবিউল আকবরকে সঙ্গে নিয়ে ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার দরবার শরীফ জিয়ারতে গিয়েছিলেন। সারারাত ইবাদত বন্দেগি শেষে শুক্রবার সকালেই বাড়ির পথ ধরেছিলেন। ফেরার পথে বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। পরে তাদের স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে নয়নকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক লিটন চৌধুরী বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই নয়নের মৃত্যু হয়। রবিউল আকবরের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।
শুক্রবার সকালে বাথুয়া গ্রামে নয়নের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। যে উঠানে মোটরসাইকেল থামিয়ে মায়ের কাছে ছুটে যাওয়ার কথা ছিল নয়নের, সেখানে এখন স্বজনদের ভিড়। সন্তানের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা। তার আহাজারিতে উপস্থিত কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। বিলাপ করে তিনি খুঁজছেন তার আদরের সন্তানকে। বিলাপ করে বারবার বলছেন, ‘আমার ছেলেটা একটু আগেই নাস্তা খাওয়ার বায়না করেছিল।’
নয়নের চাচাতো ভাই নাছিম ইভান কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, নয়ন ভাই ছিলেন আমাদের পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি, ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ থেকে শুরু করে সংসারের সব।
নয়নের চাচা ও আশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ মো. মাহবুব বলেন, মায়ে হাতের গরম পরোটা খেতে চেয়েছিল নয়ন। কিন্তু কে জানতো এভাবে নিথর দেহে সে ফিরবে? শুক্রবার জুমার পর তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক চকবাজার শাখার ম্যানেজার অপারেশন্স ওয়াহেদ মোরশেদ খবর পেয়ে ছুটে আসেন সহকর্মীর বাড়িতে। তিনি বলেন, নয়ন কেবল একজন সহকর্মী ছিলেন না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী। বৃহস্পতিবারও আমরা একসঙ্গে অফিস করেছি। তার পেশাদারিত্ব ছিল অনুকরণীয়।
জানতে চাইলে পটিয়া থানার ওসি মো. নুরুজ্জামান বলেন, দুজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। নয়ন ইসলামকে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। রবিউলকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।


