পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী কর্মীদের ৬৫ শতাংশ ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই প্রথম গর্ভধারণ করেন। এমনকি তিন নারীর মধ্যে দুইজনই ১৮ বছরের আগেই বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
সোমবার ঢাকার মহাখালীর আইসিডিডিআরবি ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এই গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার সহায়তায় আইসিডিডিআরবি পরিচালিত দুইবছরব্যাপী এই গবেষণায় উঠে এসেছে গার্মেন্ট খাতে কর্মরত তরুণী ও যুবতী নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও সহিংসতার বাস্তব চিত্র। গবেষণাটি ২০২২ সালের আগস্ট থেকে গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত কড়াইল, মিরপুর ও টঙ্গীর বস্তি এলাকায় পরিচালিত হয়, যেখানে ১৫-২৭ বছর বয়সী মোট ৭৭৮ জন নারী শ্রমিক অংশগ্রহণ করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, পোশাকশিল্পে কর্মরত ৩৩ শতাংশ নারী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হয়েছেন। ২৫ শতাংশের বেশি নারী কখনও না কখনও গর্ভপাত বা মাসিক নিয়মিতকরণের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন।
সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে, তবে যথেষ্ট নয়
গবেষণার শুরুতে যেখানে মাত্র ১৫ শতাংশ নারী জরুরি গর্ভনিরোধক সম্পর্কে জানতেন, সেখানে দুই বছর শেষে সেই সংখ্যা বেড়ে ৩৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতনতার হার ৪৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০ শতাংশ। পাশাপাশি, পরিবার পরিকল্পনায় স্বামী-স্ত্রীর যৌথ সিদ্ধান্তের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব ৫৪ শতাংশের জায়গায় এখন ৭১ শতাংশ।
সহিংসতা: ঘরেও, কর্মক্ষেত্রেও
গবেষণায় উঠে এসছে, নারী শ্রমিকরা শুধু ঘরে নয়, কর্মক্ষেত্রেও নিয়মিত সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে মানসিক সহিংসতার হার গবেষণার শুরুতে ছিল ৪৮ শতাংশ, যা বেড়ে হয়েছে ৫৫ শতাংশ। স্বামীদের দ্বারা সহিংসতা, বিশেষ করে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। চিন্তার বিষয় হলো- সহিংসতার শিকার হওয়া নারীদের অনুষ্ঠানিক সহায়তা চাওয়ার প্রবণতা কমছে। দুই বছর আগে যেখানে ৩৫ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক সহায়তা (পরিবার বা বন্ধুদের) চাইতেন, সেখানে তা এখন কমে ২১ শতাংশ নেমে এসেছে। কর্মক্ষেত্রের সহিংসতার বিষয়ে মাত্র ২০ শতাংশ নারী কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে থাকেন এই চিত্র দুই বছরেও অপরিবর্তিত। যে গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে নারী শ্রমিকরা কাজ করেন, সেখানে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানভেদে অনেকটাই অনুপস্থিত। মাত্র ২২ শতাংশ কারখানায় স্যানিটারি প্যাড সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। ১৪ শতাংশ কারখানায় পরিবার পরিকল্পনার উপকরণ বা এ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা অন্তত ৯ বছর বয়সে স্কুলে পড়েছে, বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন, সন্তান নেওয়ার আগে তারা গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। তাদের কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। অন্যদিকে, স্বামীর সহিংসতা থাকলে কিশোরী গর্ভধারণের ঝুঁকি ২৬ শতাংশ বেশি পাওয়া গেছে।
নারী ক্ষমতায়নই সহিংসতা প্রতিরোধে বড় উপাদাননারী শ্রমিকদের চলাচলের স্বাধীনতা, মতামত দেওয়ার সুযোগ, এবং পারিবারিক সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের ক্ষমতা —এই তিনটি উপাদান সরাসরি স্বামীর সহিংসতা কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
এই গবেষণার প্রধান গবেষক ও আইসিডিডিআরবির ইমিরেটাস সায়েন্টিস্ট ড. রুচিরা তাবাসসুম নভেদ বলেন, অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও পোষাক খাতের নারী শ্রমিকদের প্রজনন স্বাস্থ্য অন্যদের চেয়ে খারাপ। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বাংলাদেশ নীটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) যুগ্ম সম্পাদক ফারজানা শারমিন বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের জন্য কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য রাখা কঠিন। সরকারি ক্লিনিকের সময়সীমাও শ্রমিকদের জন্য উপযোগী নয়। এই সেবাগুলো সহজলভ্য করতে হবে।
মেরি স্টোপস বাংলাদেশের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন এইচ আহমেদ বলেন, নারীরা এখনও দোকানে গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কিনতে লজ্জা পান। তাই গার্মেন্টে এসব সামগ্রীর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পপুলেশন কাউন্সিলের সাবেক পরিচালক ড. উবাইদুর রব বলেন, নারীরা এখন শুধু গার্মেন্টেই নন, নানা কর্মক্ষেত্রে কাজ করছেন। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কমাতে হলে তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এই গবেষণার ফলাফল ভবিষ্যতে পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও অধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।