“যদি এখনই আমরা সতর্ক না হই, আমাদের ভুলের বোঝা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বইতে হবে”- এভাবেই উদ্বেগ প্রকাশ করলেন খুলনার একজন প্রবীণ পরিবেশকর্মী। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চল খুলনা আজ বনভূমি সংকটের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন এবং তার আশপাশের অঞ্চলগুলো ক্রমাগত মানুষের চাপের মুখে পড়ছে। গেলো ২২ বছরে খুলনা জেলাতেই ৪৩ হাজার ৬৮৯ একর বনভূমি বিলীন হয়েছে, যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ হার। প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে ম্যানগ্রোভ বনভূমি অপরিহার্য প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত সুরক্ষাবলয়ই আজ সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে। উপকূলীয় অঞ্চল এখনই সুরক্ষা না করলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে মনে করছে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
খুলনা বিভাগীয় বন কার্যালয়ের ২০২৩ এর তথ্যানুযায়ী দাকোপে ১৬ হাজার ৫০০ একর বনভূমি চিংড়িঘের ও বসতির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। কয়রায় সুন্দরবনের সীমান্তঘেঁষা এলাকায় প্রায় ৮হাজার২০০ একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে। এছাড়া বটিয়াঘাটায় অবৈধ বাগান, মধু আহরণ ও কাঠ কাটা মিলিয়ে অন্তত ৫ হাজার একর বনভূমি হুমকিতে। এছাড়া ২০০১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে শুধুমাত্র খুলনা জেলাতেই ৪৩ হাজার ৬৮৯ একর বনভূমি বিলীন হয়েছে। এর মধ্যে দাকোপ, কয়রা ও বটিয়াঘাটা উপজেলাগুলোতে বনভূমি হ্রাসের হার সবচেয়ে বেশি। FAO এর ২০২০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে বন উজাড়ের বার্ষিক হার ২.৬%, যা বৈশ্বিক গড়ের দ্বিগুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) ২০২১ এর পরিসংখ্যান বলছে দেশের মোট ভূমির মাত্র ১৪.১% বনভূমি। পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য প্রয়োজন ২৫%। ২০২৩ সালের বন অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন বলা হয়েছে সারাদেশে ২০০১-২০২৩ সময়ে ২লাখ ৮৭হাজার ৪শত ৫৩ একর বনভূমি হারিয়েছে। খুলনা অঞ্চলেই ১৫% এর বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তে মানববসতি, মাছের ঘের, কলকারখানা ও বিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের বসতির চাপে সুন্দরবনের বাফার জোনগুলো মারাত্মক হুমকির মুখে। এর প্রভাব পড়ছে কাঁকড়া, কচ্ছপ, জল পাখিসহ বহু প্রজাতির ওপর।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াও খুলনার বনভূমির জন্য হুমকি। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের (BCCT) ২০২২ সালের গবেষণা বলছে, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে ২০৩০ সালের মধ্যে লবণাক্ততা দ্বিগুণ হতে পারে। বর্তমানে খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার শিবসা নদীতে সর্বোচ্চ লবণাক্ততা ১৪,৫০০ μ mg/L রেকর্ড করা হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় পানির লবণাক্ততা ১,৪২৭ থেকে ২,৪০৬ μS/cm পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যা পানীয় জলের জন্য নিরাপদ সীমা (১,০০০ μ mg/L) অতিক্রম করেছে। এছাড়া বাগেরহাটে লবণাক্ততা মাঝারি থেকে উচ্চ মাত্রায় (৫,০০১-১০,০০০ μS/cm) রেকর্ড করা হয়েছে, যা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে ম্যানগ্রোভ ও কৃষিনির্ভর বনভূমি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
খুলনা বন সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসি এফ) শাহীনুর রহমান বলেন, বন অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান চালালেও প্রভাবশালী চিংড়িঘের মালিক ও স্থানীয় দখলদারদের বাধার মুখে টেকসই সাফল্য আসে না। আইনি সহায়তা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব প্রকট।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান জানান, আমরা পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া কোনো প্রকল্প অনুমোদন দেই না। তবুও মাঠ পর্যায়ে দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সুন্দরবনের ১০ কিমির মধ্যে গড়ে ওঠে অবৈধ স্থাপনা। সম্প্রতি আমরা খুলনায় ১১টি অবৈধ কারখানা বন্ধ করেছি।
অন্যদিকে, মৌ চাষ, বনজ উদ্ভিদ, মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র, হস্তশিল্প, কাঠ ও গাছ-নির্ভর শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হাজারো পরিবার আয়হীন হয়ে পড়ছে বনহানির কারণে।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. নাহিদা সুলতানা বলেন, এখনই স্থানীয় সরকার, বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটির অংশগ্রহণে কমিউনিটি ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলতে হবে। একমাত্র তখনই প্রাকৃতিক বন তার গঠনগত কাঠামো ও জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে পারবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও বাপা খুলনা শাখার সমন্বয়কারী এড. বাবুল হাওলাদার বলেন, সুন্দরবন কেবল একটি বন নয়, এটি উপকূলবাসীর টিকে থাকার সুরক্ষা বেষ্টনী। বন না থাকলে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি ও সম্পদহানির ঝুঁকি বহুগুণ বাড়বে। তিনি বলেন, সুন্দরবন হারালে শুধু গাছ নয়, হারিয়ে যাবে জলবায়ু প্রশমনের প্রাকৃতিক ঢাল। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের গতি কমানোর অন্যতম অবলম্বন এই বন। খুলনার উপকূল এখনই সুরক্ষা না পেলে সারাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য নিরাপত্তা, জীবিকায় হুমকি এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের রূপ ছড়িয়ে পড়বে।