বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর পরিসংখ্যানের খাতায় সীমাবদ্ধ নেই; এটি মানুষের সু-স্বাস্থ্য, জীবন-জীবিকা এবং মানসিক স্থিতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে পরিবর্তনগুলো পরিলক্ষিত হচ্ছে-তা দেখে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমরা জলবায়ু সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছি। বৈজ্ঞানিক তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮০ সালের পর থেকে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রায় ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে এবং আর্দ্রতার কারণে অনুভূত তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এই বৃদ্ধিকে আর সাধারণ আবহাওয়া পরিবর্তন বলা যায় না- এটি এখন জনস্বাস্থ্য সংকটের অন্যতম কারণ।
তাপপ্রবাহের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে শহরাঞ্চলে। দ্রুত নগরায়ণ, হঠাৎ বনভূমি হ্রাস, তাপ ধারণকারী কংক্রিট কাঠামো- সব মিলিয়ে তাপমাত্রা গত চার দশকে প্রায় ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এই অতিরিক্ত উষ্ণতা শুধু অস্বস্তি তৈরি করছে না; বরং শ্বাসতন্ত্রের রোগ, পানিশূন্যতা, মাথা ঘোরা, হৃদরোগের ঝুঁকি এবং মানসিক চাপ বাড়িয়ে জনস্বাস্থ্যকে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতি কম হয়নি- ২০২৪ সালে তাপজনিত অসুস্থতার কারণে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১.৭৮ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে যে তথ্য পাওয়া যায়, তা পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে।
অন্যদিকে, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ও অতিবৃষ্টি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আরেকটি তীব্র চাপ তৈরি করছে। ২০২৪ সালের বন্যা- যা কয়েক মিলিয়ন মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং অন্তত ৭১ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছেল। বন্যার পরপরই ডায়রিয়া, ত্বকের রোগ, পানিবাহিত সংক্রমণসহ বিভিন্ন অসুখ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র ২৪ ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন- যা পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে না; বরং দুর্যোগের পরবর্তী সময়টাও স্বাভাবিক জীবনের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হতে পারে।
উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে পরিস্থিতি আরও সঙ্কটাপন্ন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলে লবণাক্ততা দিন দিন বাড়ছে- যা পানীয় জলকে অস্বাস্থ্যকর করে তুলছে এবং কৃষিজমির উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। সরকারের পরিবেশগত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাগরের উচ্চতা বছরে গড়ে ৩.৬ থেকে ৪.৫ মিলিমিটার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে মানুষের খাদ্যাভ্যাস, পুষ্টি এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য অবস্থায়। লবণাক্ত পানি পান করার ফলে উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা ও ত্বকজনিত অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ছে। একই সঙ্গে কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ায় খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে- যা দীর্ঘমেয়াদে পুষ্টিহীনতা ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও যে গভীর প্রভাব ফেলছে, তা স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও নদীভাঙনের মতো দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবনযাত্রায়। আশ্রয়হীনতা, জীবিকা হারানো, পুনর্বাসনের অনিশ্চয়তা, ক্ষতির ভয়- এসব বিষয় ট্রমা, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার মতো সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে। যদিও বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যের সুনির্দিষ্ট জাতীয় পরিসংখ্যান সীমিত, তবে মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণগুলো বলছে- জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে।
সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিভিন্ন আইন ও নীতি প্রণয়ন করেছে- যেমন ২০০৯ সালের বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান, জাতীয় পরিবেশনীতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, পানি নীতি, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন, এবং ২০২২ সালের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা। এগুলো স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। পাশাপাশি প্যারিস চুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অঙ্গীকারও উল্লেখযোগ্য।
তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ- এই নীতিমালা বাস্তবায়নের দুর্বলতা। মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, তথ্য সংগ্রহের ঘাটতি, বাজেটের সীমাবদ্ধতা, মাঠপর্যায়ে সচেতনতার অভাব- এসব কারণে নীতিমালার সুফল জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। বিশেষ করে উপকূল, চরাঞ্চল ও দুর্গম এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্য জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো- জলবায়ু পরিবর্তনকে জনস্বাস্থ্যের কেন্দ্রীয় ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করা। তাপদাহ মোকাবিলায় শহরে সবুজায়ন বৃদ্ধি, লবণমুক্ত পানির ব্যবস্থা, বন্যাপ্রবণ এলাকায় চিকিৎসা সুবিধা জোরদার, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা এবং জলবায়ু-স্বাস্থ্য ডেটাবেইজ শক্তিশালী করা- এসব উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক তহবিল ব্যবহারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং গবেষণা নির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তন কেবল পরিবেশগত সমস্যা নয়- এটি মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই এখনই প্রয়োজন দ্রুত, সমন্বিত ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই মানে মানুষের জন্য ন্যায্য, নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লড়াই- এটি আজ স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে।
লেখক: কাজী মোহাম্মদ হাসিবুল হক, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশকর্মী


