সাদিক আল সরকার :: জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে বৈশ্বিকভাবে আলোচিত ও উদ্বেগজনক একটি বিষয়। তবে এর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাবগুলো পড়ছে উন্নয়নশীল ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর, যার অন্যতম উদাহরণ বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থান, ঘনবসতি, দারিদ্র্যতা, দুর্বল অবকাঠামো ও নদীনির্ভর জীবনধারার কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের অন্যতম ভুক্তভোগী।
যদিও বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস (পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইডসহ বিভিন্ন গ্যাসের নিঃসরণ) নির্গমনে বাংলাদেশের অবদান অত্যন্ত সামান্য, তবুও এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে দেশের কোটি কোটি মানুষকে।
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যা পৃথিবীর বৃহত্তম নদী ব্যবস্থার (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা) মুখে অবস্থিত। এর পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা, নিচু ভূ-প্রকৃতি ও ঘনবসতি বাংলাদেশের জলবায়ু সংবেদনশীলতাকে বাড়িয়ে তোলে।
বিগত কয়েক দশকে দেশের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, বর্ষার আচরণ বদলেছে, এবং ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়েছে। একদিকে যেমন খরা ও অনাবৃষ্টির কারণে উত্তরাঞ্চলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে উপকূলে লবণাক্ততা ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে
১. উপকূলীয় অঞ্চল হুমকির মুখে
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, ভোলা প্রভৃতি উপকূলীয় জেলা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি শিকার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ঘন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এসব এলাকায় লবণাক্ততা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। মাটির উর্বরতা হ্রাস পাওয়ায় কৃষিজ উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে স্থানচ্যুত হচ্ছে, যা একটি নতুন সংকট ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’।
২. চাষাবাদ ও খাদ্য নিরাপত্তা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষির মৌসুমি স্বাভাবিকতা নষ্ট হচ্ছে। আগে নির্দিষ্ট সময়ে যে বৃষ্টি হতো, এখন তা কখনো অতিরিক্ত, কখনো একেবারেই অনুপস্থিত। আমন ধান, পাট, গম, আলুসহ বহু কৃষিপণ্য উৎপাদনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে, যা দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বাড়াতে পারে।
৩. স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি
উচ্চ তাপমাত্রা, পানির অভাব এবং দূষণের কারণে বাংলাদেশে ডায়রিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও হিটস্ট্রোকের মতো রোগের প্রকোপ বাড়ছে। তাপদাহ শহরাঞ্চলে ক্রমাগত বাড়ছে, যার প্রভাব বেশি পড়ছে শিশু ও বয়স্কদের ওপর।
৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বৃদ্ধি
ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ (২০০৭), ‘আইলা’ (২০০৯), ‘আম্পান’ (২০২০) ইত্যাদি ঝড়গুলো প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন আরও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। এই ধরনের দুর্যোগে জীবনহানির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ও কৃষি ব্যবস্থাও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫. খাদ্যাভ্যাস ও গৃহপালিত গবাদি পশুর ওপর প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্যাভ্যাস ও গবাদি পশুর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় গবাদি পশুর খাদ্য সংকট তৈরি করে। এর ফলে, গবাদি পশুদের স্বাস্থ্য, প্রজনন ক্ষমতা, এবং দুধ উৎপাদনও কমে যায়। একই সাথে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রোগ-বালাই ও পরজীবী সংক্রমণও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা গবাদি পশুর জীবনযাত্রাকে আরো কঠিন করে তুলেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন, জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা। এছাড়া, উপকূলীয় অঞ্চলে অভিযোজন প্রকল্প গ্রহণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমেও সরকার এই সংকট মোকাবিলায় কাজ করছে। ২০০৯ সালে ‘Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP)’ তৈরি করা হয়। এর আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেমন: উপকূলীয় বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়ন, সাইক্লোন শেল্টার স্থাপন ও সম্প্রসারণ, লবণাক্ততা সহনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন, পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুৎ চালিত সেচ ব্যবস্থা।
‘ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্ল্যান’–এর মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ, যারা “Climate Vulnerable Forum” (CVF)-এর সভাপতিত্ব করে বৈশ্বিক জলবায়ু ন্যায়বিচার দাবি করে আসছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করণীয়-
১. নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রসার
সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদির ব্যবহার বাড়িয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। এতে পরিবেশ দূষণ কমবে এবং দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি খাতে স্বনির্ভরতা আসবে।
২. বনায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ
বনের পরিমাণ বাড়াতে হবে। নদী, খাল, বিল ও জলাশয় সংরক্ষণ করতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে এবং শহরে সবুজ এলাকা বৃদ্ধির জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
৩. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
৪. জলবায়ু অভিযোজন প্রযুক্তি প্রসার
লবণসহিষ্ণু ও খরারোধী ফসল উদ্ভাবন, বন্যা সহনশীল গৃহনির্মাণ, এবং পানি সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক সহায়তা ও ন্যায়বিচার দাবি
বাংলাদেশের মতো দেশের প্রয়োজনে জলবায়ু তহবিল নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর উচিত পরিবেশ দূষণের জন্য দায় স্বীকার করে অর্থ ও প্রযুক্তি সহায়তা বৃদ্ধি করা।
জলবায়ু পরিবর্তন শুধু একটি পরিবেশগত সংকট নয়, এটি একটি মানবিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটও বটে। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশে এই সংকট মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস না করে, পরিবেশবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে জলবায়ু ন্যায়বিচার দাবি করেই টেকসই ভবিষ্যতের পথ তৈরি করা সম্ভব।
পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ে দেশের কিছু অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে বেশকিছু আশানুরূপ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর মধ্যে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ উল্লেখযোগ্য। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব-নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিবেশ রক্ষা করা এবং জলবায়ু সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। কারণ এই পৃথিবী কেবল আমাদের নয়, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মেরও।