জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র অভিঘাতে যখন কৃষি, খাদ্যব্যবস্থা ও গ্রামীণ জীবিকা অভূতপূর্ব ঝুঁকিতে, ঠিক সেই সময় ব্রাজিলের বেলেমে চলমান কপ-৩০–এর গতকালকার পুরো দিনজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, নারী নেতৃত্ব, পরিবারভিত্তিক কৃষি, আফ্রো-বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং টেকসই পর্যটন। আলোচনার সারকথা ছিল—ভূমি পুনরুদ্ধার, নারীর ক্ষমতায়ন ও বিজ্ঞাননির্ভর উদ্ভাবনের মাধ্যমে ভবিষ্যতের খাদ্যব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা।
আমাজনের হৃদস্পন্দনঘেরা বেলেম শহর এখন বৈশ্বিক জলবায়ু কূটনীতির সবচেয়ে তাৎপর্যময় সময় অতিক্রম করছে। এর মধ্যে ১৯ নভেম্বর কপ-৩০–এর জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যখন বিশ্ব খাদ্যব্যবস্থা টালমাটাল, কৃষিজমির স্থায়িত্ব হুমকির মুখে, আর নারী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে—তখনই বেলেমের সম্মেলন কক্ষগুলো মুখর হয়ে ওঠে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে। আলোচনায় উদ্বেগ থাকলেও সমাধানের জন্য সবাই সমানভাবে আগ্রহী; কারণ পৃথিবী রক্ষার বিকল্প নেই।
দিনের প্রথম উচ্চপর্যায়ের সেশন ছিল ‘উইমেন ভয়েসেস দ্যাট গাইড দ্য ফিউচার’। এখানে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী নারীরা তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তাঁরা জানান—কীভাবে পানি সংকট মোকাবিলা, লবণাক্ত জমিতে নতুন ফসল উদ্ভাবন, প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনার নতুন কৌশল তৈরি এবং স্থানীয় জ্ঞানকে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে সমাধান খুঁজে নিচ্ছেন প্রতিদিন। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে জলবায়ু নীতির মূল স্তম্ভ হিসেবে নারী নেতৃত্বের গুরুত্ব আরও জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা পায়।
এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিল ঘোষণা করে তাদের জাতীয় নীতি—‘প্রটোকল ফর উইমেন অ্যান্ড গার্লস ইন ক্লাইমেট ইমার্জেন্সিস’। দুর্যোগের সময়ে নারী ও কন্যাশিশুর নিরাপত্তা, অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব এবং সহায়তার কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে এই প্রটোকলে। জলবায়ু জরুরি পরিস্থিতিতে নারী নেতৃত্বকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করতে এটি কপ-৩০ অ্যাকশন এজেন্ডায় বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
এরপর উদ্বোধন করা হয় আলোচিত ইভেন্ট ‘রাউজ—রিসাইলেন্ট অ্যাগ্রিকালচার ইনভেস্টমেন্ট ফর নেট-জিরো ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন’। উদ্বোধনী বক্তব্যে বিজ্ঞানীরা জানান—বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর লাখ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে। বাড়ছে ভূমি অবক্ষয়, খাদ্যের দাম ও কৃষিজীবিকার অনিশ্চয়তা। এই পরিস্থিতিতে রাউজ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো টেকসই কৃষি চর্চা বিস্তার, ক্ষতিগ্রস্ত জমি পুনরুদ্ধার, কৃষিজমিতে কার্বন সংরক্ষণ বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকা শক্তিশালী করার জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো।
দুপুরের আগে অনুষ্ঠিত ‘স্কেলিং আপ প্র্যাকটিক্যাল সলিউশনস ফর রিসাইলেন্ট অ্যাগ্রি-ফুড সিস্টেমস’ সেশনে একাধিক নতুন উদ্যোগ ঘোষণা করা হয়। প্রকাশিত হয় বিসিএনই অ্যাগ্রিকালচার ফেলোশিপ–এর ২০১৬–২০২৮ নতুন কর্মপরিকল্পনা। বৈশ্বিক সারব্যবহারের দক্ষতা বাড়াতে ঘোষণা করা হয় ‘ফার্টিলাইজার কল টু অ্যাকশন’। এছাড়া ২০২৫ সালের সিআরডিএফ বিশ্লেষণ প্রকাশ এবং জামান সরকারের ফাস্ট পার্টনারশিপে নতুন সহায়তা—কৃষির গ্রিনহাউস গ্যাস কমানো, উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু–সহনশীল খাদ্যব্যবস্থা গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানানো হয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সেশনে ‘ইন্টিগ্রেটিং উইমেন ইন দ্য ফাইট এগেইনস্ট দ্য ক্লাইমেট ক্রাইসিস’ আলোচনায় নারী নেতৃত্বকে জলবায়ু শাসনব্যবস্থায় আরও গভীরভাবে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা উঠে আসে। বক্তারা বলেন—নারী নেতৃত্বকে শক্তিশালী না করলে বৈশ্বিক কৃষি-খাদ্যব্যবস্থার রূপান্তর অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেশন—‘গ্লোবাল ক্লাইমেট অ্যাকশন হাই-লেভেল ইভেন্ট’। নেতারা বলেন—“এখন আর প্রতিশ্রুতি নয়, দরকার বাস্তব পদক্ষেপ।” সম্মিলিত আহ্বান জানানো হয় ‘মুতিরাও’—অর্থাৎ সরকার, গবেষক, কৃষক, সমাজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে একযোগে দ্রুতগতিতে কাজ করতে হবে। সতর্ক করা হয়—যদি এখনই ভূমি পুনরুদ্ধার, খাদ্য উৎপাদন অভিযোজন, নারী নেতৃত্ব, আফ্রো-বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের জন্য দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে পরবর্তী প্রজন্মকে ভয়াবহ খাদ্য ও পরিবেশ সংকটের মুখোমুখি হতে হবে।
দিনশেষে বেলেমের আলোচনার সামগ্রিক বার্তা ছিল একটাই—কপ-৩০ এখন শেষ মুহূর্তের কঠিন দরকষাকষিতে ব্যস্ত, তবে সবাই একই লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে—পৃথিবীকে রক্ষার পথে একটি কার্যকর ও টেকসই সমাধানে পৌঁছানো।


