আজ (সোমবার) থেকে রেইন ফরেস্টের দেশ ব্রাজিলের বেলেম নগরীতে শুরু হচ্ছে ৩০তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন। বিশ্বের ১৫০টি দেশের প্রতিনিধি দল এরই মধ্যে ব্রাজিলের বেলেম নগরীতে এসে পৌঁছেছে। নগরী পরিণত হয়েছে একটি ‘জলবায়ু উৎসব’ নগরীতে। ব্রাজিরের বেলেম-পারা এলাকাকে সুসজ্জিত করা হয়েছে চোখ ধাঁধানো উপকরণে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ‘অ্যামাজন’-এর গ্যাটওয়ে বলা হয় বেলেম শহরকে। জীববৈচিত্র্যের বিশাল ভা-ার অ্যামাজন নদী ও জঙ্গলের দেশ ব্রাজিলকেই এবার বেছে নেয়া হয়েছে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের জন্য। পরিবেশবাদী ও প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এ সম্মেলন জলবায়ু, কর্মপরিকল্পনার পরবর্তী ধাপ নির্ধারণ এবং বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসি) আয়োজিত এ সম্মেলন চলবে আগামী ২১ নভেম্বর পর্যন্ত। বাংলাদেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ এই সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে বিশ্বের ১৫০টি দেশের প্রতিনিধি। এ ছাড়া জলবায়ু নিয়ে কাজ করছে এমন দুই শতাধিক অংশীজন (স্টেকহোল্ডার)।
৩০তম জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (কপ-৩০) যোগ দিতে এরই মধ্যে বাংলাদেশের ১২ সদসের একটি প্রতিনিধি দল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের বেলম পৌঁছেছে। প্রতিনিধি দলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নেতৃত্ব দেয়ার কথা থাকলেও সরকারের ব্যাং সঙ্কোচন নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কপ-৩০-এর আলোচনায় অংশ নিতে পারেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে কারা আছেন সেটি প্রকাশ করা হয়নি। তবে সরকারি প্রতিনিধি দলে পাঁচ তরুণ নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেনÑ শাহ রাফায়াত চৌধুরী, ফারজানা ফারুক ঝুমু, আমানুল্লাহ পরাগ, বারীশ এইচ চৌধুরী এবং সোহানুর রহমান। এছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের, অতিরিক্ত সচিব মো. ইমাম উদ্দীন কবীর প্রতিনিধি দলে রয়েছেন। এছাড়াও সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল থেকে দুই শিশুসহ যুব প্রতিনিধি, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এতে যোগ দিচ্ছেন।
আশা করা হচ্ছে, জলবায়ু ন্যায় বিচার, অভিযোজন এবং অর্থায়নের ওপর জোর দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল একটি দৃঢ় অবস্থান নেবে।
বিশ্বের সর্ব বৃহৎ আমাজন রেইন ফরেস্ট বনের দেশ ব্রাজিলের বেলেম নগরী এখন বিশ্ব জলবায়ু নেতৃবৃন্দ ও ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্টদের পদভারে মুখরিত। তবে এবারের উপস্থিতি অন্য সম্মেলনগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম। এ কারণ হিসেবে জানা গেছে, দেশটির দূরত্ব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নিরাপত্তাহীনতা, উড়োজাহাজ ও হোটেল কক্ষের উচ্চ ভাড়া কারণে বাংলাদেশসহ অনেক দেশের প্রতিনিধি দলের আকার ছোট। যাতায়াত ও আবাসন খরচ দুই থেকে তিনগুণ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে উন্নয়নশীল ও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দরিদ্র দেশগুলোর ওপর। জলবায়ু ন্যায়বিচারের আলোচনায় তাদের উপস্থিতি কম। ফলে কপের এই আসরে ভুক্তভোগী দেশের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পুরো সম্মেলন একতরফা হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। অনেক দরিদ্র দেশ ব্রাজিল সরকারের কাছে সাশ্রয়ী ফ্লাইট ও বিকল্প আবাসনের দাবি জানালেও সাড়া দেয়নি আয়োজক দেশ ব্রাজিল কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক টানাপড়েন, অর্থনৈতিক ধীরগতি, করপোরেট আধিপত্য এবং শক্তিধর দেশের চাপে প্রত্যাশা আগের তুলনায় এবার অনেক কম। এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে, কপ-৩০ কি আন্তর্জাতিক জলবায়ু কূটনীতির ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে? নাকি আবারো প্রতিশ্রুতির ফানুস চুপসে যাবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিন দশক ধরে চলে আসা এই শীর্ষ সম্মেলন এখন অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক হয়ে পড়েছে, যা বাস্তব পদক্ষেপ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তাদের মত, সময় এসেছে পুরো প্রক্রিয়া পুনর্গঠনের।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এবার কপ-৩০-এ নিবন্ধিত প্রতিনিধি মাত্র ১২ হাজার ২০০। অথচ গত বছর আজারবাইজানের বাকুতে কপ-২৯-এ ৫৪ হাজার এবং ২০২৩ সালে দুবাইয়ের কপ-২৮-এ ৮৪ হাজার নিবন্ধিত প্রতিনিধি ছিলেন। ব্রাজিল আশা করেছিল, অন্তত ৪৫ হাজার প্রতিনিধি এবার উপস্থিত হবেন। কিন্তু উচ্চ ভ্রমণ খরচ ও সীমিত আবাসন সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমিয়েছে। ব্রাজিলের বেলেম শহরে অন্তত ৫৩ হাজার অতিথির জন্য আবাসন প্রস্তুত করা হলেও আয়োজকরা নানা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে। উচ্চ বিমান ভাড়া, ব্যয়বহুল হোটেল ও জটিল যাত্রাপথ অনেকের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত করে তুলেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো।
উচ্চ খরচের কারণে বাংলাদেশও কমিয়েছে প্রতিনিধি সংখ্যা। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, কপ-৩০-এ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও সচিব ফারহিনা আহমেদ কপ-৩০-তে যোগ দিচ্ছেন না। তবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ১২ জনের একটি প্রতিনিধি দল কপে অংশ নেবে। পাশাপাশি প্রথমবারের মতো কপে যোগ দিচ্ছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। উপদেষ্টা ফরিদা আখতারসহ দুজন সম্মেলনে থাকছেন। কপে অংশ নেয়ার ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, এবার বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে জায়গা পাবে ইলিশ, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মতো প্রাণিসম্পদের তথ্য ও ছবি। জলবায়ু সমস্যা কীভাবে দেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, তা কপ সম্মেলনে তুলে ধরা হবে।
পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক শওকত আলী মির্জা বলেন, উড়োজাহাজের বিজনেস ক্লাসের ভাড়া ২৭ লাখ টাকারও বেশি। আর ইকোনমিতে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। ফলে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল ছোট করা হয়েছে।


