গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত পাঁচ বছর বয়সী কন্যাশিশু রজবের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত ডকুড্রামা ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব’ ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিলভার লায়ন পুরস্কার জিতেছে। ‘সিলভার লায়ন’ এই উৎসবের দ্বিতীয় সেরা ছবির পুরস্কার। ছবিটি নির্মাণ করেছেন ফরাসি-তিউনিসীয় পরিচালক কুসারু বিন হানিয়া।
গতকাল শনিবার এই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ফেস্টিভ্যালে প্রথম পুরস্কার গোল্ডেন লায়ন পেয়েছে মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা জিম জারমুশ পরিচালিত ‘ফাদার মাদার সিস্টার ব্রাদার’ চলচ্চিত্রটি।
এক সত্য ঘটনা নিয়ে নির্মিত ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব’। এই চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে হিন্দ রজবের কথা যে গত বছর গাজা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে পালাতে গিয়ে ইসরায়েলি হামলায় মারা যায়।
২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি গাড়িতে থাকা অবস্থায় ইসরায়েলি হামলার মুখে পড়ে রজব, তার চাচা, চাচি ও তিন চাচাতো ভাইবোন। সে সময় তারা গাজার রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু এরই মধ্যে ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারায় ৫ বছর বয়সী রজব ছাড়া গাড়িতে থাকা সবাই। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কাছে সাহায্য চাচ্ছিল শিশুটি। সেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলা ফোনকলের অডিওটি এই চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। অডিওতে শোনা যায়, উদ্ধারকর্মীরা রজবকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সে সময় সে গাড়ির ভেতরে পরিবারের নিথর দেহগুলোর মাঝে আটকে ছিল। সামরিক প্রক্রিয়া শেষে রজবকে উদ্ধারে দুজন উদ্ধারকর্মীও যান সেখানে। কিন্তু ততক্ষণে ইসরায়েলিদের গুলিতে শিশুটির মৃত্যু হয়। প্রাণ হারাতে হয় উদ্ধার করতে যাওয়া দুজনকেও।
দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব এবারের ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা। গত বুধবার এর প্রিমিয়ারের পর টানা ২৩ মিনিট ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ পায় চলচ্চিত্রটি। করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে ভেনিস উৎসব। গাজার শিশুদের প্রতি সমর্থন জানানো হয়। সে সময় এটিকে পুরস্কারের সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন অনেকে।
পুরস্কার গ্রহণকালে পরিচালক বেন হানিয়া বলেন, ‘হিন্দ রজবের গল্প শুধু এক শিশুকন্যার নয়, বরং দুঃখজনকভাবে গণহত্যার শিকার সমগ্র একটি জাতির কাহিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিনেমাটি রজবকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না, তার ওপর চালানো বর্বরতাও মুছে দিতে পারবে না। যা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তা কোনোদিনই ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে সিনেমা তার কণ্ঠকে সংরক্ষণ করতে পারে, সীমান্ত পেরিয়ে সেটিকে প্রতিধ্বনিত করতে পারে।’
পরিচালকের ভাষায়, ‘তার কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে যতদিন না প্রকৃত জবাবদিহি নিশ্চিত হয়, যতদিন না ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।’
গাজার ওপর ইসরায়েলের চলমান আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৬৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ হাজারেরও বেশি শিশু।
গোল্ডেন লায়নজয়ী জিম জারমুশ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে গাজায় ইসরায়েলের চলমান অবরোধ ও বোমা হামলার তীব্র বিরোধিতা জানানোর বার্তা দেন। এ সময় তাঁর বুকে ঝুলছিল একটি ব্যাজ, যাতে লেখা ছিল ‘Enough’ অর্থাৎ যথেষ্ট হয়েছে।
এর আগে নিজের ‘ফাদার মাদার সিস্টার ব্রাদার’ চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ারের সময় ৭২ বছর বয়সী এই পরিচালক স্বীকার করেন, তাঁর প্রধান পরিবেশকদের একজন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত একটি কোম্পানি থেকে অর্থ নিয়েছে। এ নিয়ে তিনি বিব্রত ও উদ্বিগ্ন। জারমুশের পুরস্কারজয়ী চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন কেট ব্ল্যানচেট, অ্যাডাম ড্রাইভার ও টম ওয়েটস। তিন পর্বে নির্মিত এই ছবিটি মূলত বাবা-মা ও প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের অস্বস্তিকর সম্পর্ককে ঘিরে।
সেরা অভিনেতার পুরস্কারজয়ী সেরভিল্লোও ছিলেন সেই কয়েকজন পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীর একজন, যারা মঞ্চে দাঁড়িয়ে গাজা নিয়ে বক্তব্য দেন। তিনি ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙতে চেষ্টা করা নৌ-অভিযানে যুক্ত কর্মীদের প্রতি নিজের শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন।
হরাইজনস সাইডবার বিভাগে সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতেছেন অন্নপূর্ণা রায়। ফরাসি নির্মাতা জুলিয়া ডুকুরনো নেতৃত্বাধীন এই আবিষ্কারমূলক বিভাগে পুরস্কার গ্রহণের সময় তিনিও গাজার সংঘাতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন।
ভারতীয় নির্মাতা রায় তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সংস অব ফরগটেন ট্রিস’-এর জন্য পুরস্কৃত হন। ছবিটি মুম্বাইয়ের দুই অভিবাসী নারীর গল্পকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
রায় বলেন, ‘প্রতিটি শিশুই শান্তি, স্বাধীনতা ও মুক্তির অধিকারী। ফিলিস্তিনও এর ব্যতিক্রম নয়। আমি ফিলিস্তিনের পাশে আছি। এতে আমার দেশ রুষ্ট হতে পারে, কিন্তু এখন আর তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।’
আর্মানি বিউটির অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা মরক্কোর মরিয়ম তৌজানিও গাজার সংঘাতের প্রসঙ্গ সামনে আনেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘কতজন মাকে নিঃসন্তান করা হয়েছে? আর কতজনকে এমন পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে, এই বিভীষিকা থামার আগে? আমরা আমাদের মানবিকতা হারাতে রাজি নই।’
ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতেছেন বেনি সাফদি। তাঁর চলচ্চিত্র ‘দ্য স্ম্যাশিং মেশিন’-এ বাস্তব জীবনের মিক্সড মার্শাল আর্টস অগ্রদূত মার্ক কারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ডোয়েন ‘দ্য রক’ জনসন।
বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছেন ইতালির জিয়ানফ্রাঙ্কো রোসি। তাঁর সাদা-কালো প্রামাণ্যচিত্র ‘বিলো দ্য ক্লাউডস’ নেপলসের বিশৃঙ্খল দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরের জীবনকে তুলে ধরেছে, যেখানে ঘন ঘন ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের হুমকি নিত্যসঙ্গী।
‘লা গ্রাজিয়া’ চলচ্চিত্রে ক্লান্ত এক প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তের ব্যঙ্গাত্মক চরিত্রচিত্রণের জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান ইতালির টনি সেরভিল্লো।
আর চীনের শিন ঝিলেই সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন ‘দ্য সান রাইজেস অন আস অল’ চলচ্চিত্রের জন্য। এ ছবিটি আত্মত্যাগ, অপরাধবোধ ও অমীমাংসিত আবেগের প্রশ্নকে অনুসন্ধান করে, যেখানে অতীতের অন্ধকার গোপনীয়তা বয়ে বেড়ানো দুই প্রাক্তন প্রেমিক-প্রেমিকার গল্প বলা হয়েছে।
পৃথিবীর প্রাচীনতম চলচ্চিত্র উৎসব ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালকে পুরস্কার মৌসুমের সূচনা হিসেবে ভাবা হয়। এই পুরস্কারপ্রাপ্তি থেকে ধারণা করা যায় অস্কারের দৌড়ে এগিয়ে আছে কারা। গত চার বছরে ভেনিসে প্রিমিয়ার হওয়া চলচ্চিত্রগুলো অস্কারে ৯০টিরও বেশি মনোনয়ন পেয়েছে এবং জিতেছে প্রায় ২০টি পুরস্কার।