নগরকান্দার ফুলসূতী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্তের বিচার চাওয়ার অপরাধে হামলা এবং মারধরের শিকার হয়েছেন তার বড় বোন ও বাবা। এ ঘটনায় ভবুকদিয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকার ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক শুক্রবার রাতে প্রায় ৩ ঘণ্টা আবরোধ করে বিচার চান বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা। এ ঘটনায় ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ।
এলাকাবাসী জানান, বৈষম্যবিরোধী সংগঠনের নেত্রী বৈশাখী ইসলাম বর্ষার ছোট বোন উত্ত্যক্তের শিকার হন একই এলাকার এক ছেলের দ্বারা। বিষয়টি এলাকাবাসীকে জানালে এ ব্যাপারে সালিশবৈঠক ডাকা হয়। সালিশবৈঠক না হওয়ায় শুক্রবার বৈশাখী বিষয়টি নিয়ে থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের পর ওই ছেলের বন্ধুবান্ধব মিলে বৈশাখী ও তার বাবার ওপর হামলা চালায়।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় জানা গেছে, বৈশাখী ইসলাম বর্ষার ওপর হামলার খবর পেয়ে নগরকান্দা থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যান। একই সময় ফরিদপুর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে যান। এ সময় পুলিশ এ হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আটক করে থানায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। স্থানীয়রা পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের কাঠের লাঠি দিয়ে মারধর করেন। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আটক ব্যক্তিদের থানায় নিয়ে আসেন। বৈশাখীর ওপর হামলার প্রতিবাদে ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়ক প্রায় তিন ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। পরে সেনাবাহিনী এসে হামলাকারীদের বিচারের আশ্বাস দিলে সড়ক ছেড়ে দেন তারা।
এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ ছয়জনকে আটক করেছে। আটককৃতরা হলেন— ওই এলাকার আরিফ হোসেন (২৪), মো. আজিজুল শেখ (১৬), শরিফ শেখ (২০), সজিব শেখ (২৩) ও সাজ্জাদ শেখ (১৭)।
বৈশাখী ফেসবুকে লাইভে যা বলেন
ঘটনার পর তাৎক্ষণিক বৈশাখী ইসলাম তার নিজ ফেসবুক আইডি থেকে পরপর দুটি লাইভ করেন। দুটি লাইভে বক্তব্যে বর্ষা বলেন, ‘আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। আমি একটা ইভটিজিংয়ের কেস নিয়ে প্রতিবাদ করাতে বিএনপির লোকজন আমাকে রাস্তায় ফেলে মারধর করছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কি জুলাই আন্দোলন করা ভুল ছিল? যার কারণে রাস্তায় ফেলে বিএনপির লোকজন আমাকে মারছে। তারা আমাকে, একজন মেয়ে বলে, ইচ্ছামতো চুল ধরে টেনে লাথি মেরেছেন। আমার বাবাকে খুঁজছে মারার জন্য। আমি খুব বাজে অবস্থায় আছি। আমি কী করব, বুঝতে পারছি না।’
বর্ষার মা ফাতেমা বেগমের অভিযোগ
বর্ষার মা ফাতেমা বেগম জানান, ‘ইউএনওর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানানোর পরে তিনি নগরকান্দা থানায় যেতে বলেন। এরপর তারা নগরকান্দা থানায় যান এবং লিখিত অভিযোগ করেন। পরে ছয়জন পুলিশের একটি দল তাদের নিয়ে ভবুকদিয়ায় যায়। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পরপরই বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ওই এলাকার সেকেন গাজী, সাগর গাজী, ইমরান, জামাল বেপারিসহ তাদের লোকেরা পুলিশের উপস্থিতিতেই বর্ষা ও তার বাবার ওপরে হামলা চালায়।’
পরিবার সূত্র জানায়, বর্ষার পরিবারের ইভটিজিংয়ের ঘটনা নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক বদিউজ্জামান তারা মোল্লার উপস্থিতিতে সালিশ হওয়ার কথা ছিল। তবে তারা মোল্লা নির্ধারিত সময়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে নাড়ুয়াহাটি নামক স্থানে আরেকটি সালিশে উপস্থিত থাকায় তিনি এই সালিশে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
স্থানীয় ফরহাদ মাতব্বরের ভাই মুরাদ মাতব্বর ডাঙ্গী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একাংশের আহ্বায়ক। বিগত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মুরাদ হাওলাদার স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা জামাল হোসেন মিয়ার সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। তবে হামলার পর পুলিশের ব্যাপক অভিযানে ফরহাদ ও তার লোকজন আত্মগোপনে চলে গেছেন বলে জানা যায়।
এদিকে ফরিদপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগ্ম সদস্য সচিব বৈশাখী ইসলাম বর্ষা ও তার বাবা বাবু শেখের ওপরে হামলার পর সন্ধ্যায় জড়িতদের গ্রেফতার করতে গেলে অভিযুক্তরা সংঘবদ্ধ হয়ে পুলিশসহ ভুক্তভোগীদের ওপরে ফের হামলা চালায়। এতে এক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
এদিকে নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক কুন্তল সাহা জানান, এ ঘটনায় হান্নান শরীফ নামে আহত পুলিশের এক সদস্যকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বিবৃতি
ফরিদপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র কাজী জেবা তাহসিন বলেন, ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ও প্রতিকার চেয়ে লিখিত বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। তাহসিন উল্লেখ করেছেন, বিএনপির এক ক্যান্ডিডেট ও তার ছেলে প্রকাশ্য দিবালোকে বর্ষাকে চুল ধরে টেনে মারধর ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এ নির্মম ও কাপুরুষোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
ফরিদপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কাজী রিয়াজ বলেন, পুলিশের ওপর হামলা আমরাই প্রতিরোধ করেছি। আমাদের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। থানার দ্বিতীয় কর্মকর্তা আমিরুল ও থানাপুলিশের গাড়িচালক আব্দুল হান্নান শরীফ লাঞ্ছিত ও আহত হয়েছেন। পরে ওই এলাকায় রাতে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। ফলে অত্র এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বিএনপির নেতাদের ভাষ্য
নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান মোল্লা জানান, ওই সমন্বয়ক ও যে ছেলের সঙ্গে এ ঘটনা তারা দুই পরিবারই আওয়ামী লীগ ঘরানার পরিবারের সদস্য। ঘটনার সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, এটি ভাবুকদিয়া গ্রামে দুই পরিবারের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। এর সঙ্গে বিএনপি কিংবা রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
আহত পুলিশ সদস্য ও পুলিশের বক্তব্য
নগরকান্দা থানাপুলিশের গাড়িচালক আব্দুল হান্নান শরীফ (৫৬) বলেন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমরা আসামি ধরে আনতে গেলে স্থানীয় প্রায় দেড় শতাধিক লোকজন পুলিশের গাড়ি ঘিরে ফেলে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। স্থানীয়রা আমার হাত ও মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নিয়ে যায়, গাড়ির পর্দা ছিঁড়ে ফেলে। তবে তারা আসামি ছিনিয়ে নিতে পারেনি। তাদের গ্রেফতার করে থানায় আনা হয়েছে।
ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নগরকান্দা সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্বরত) আসিফ ইকবাল বলেন, একটি মেয়েকে উত্ত্যক্তের ঘটনা কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এ ছাড়া উত্ত্যক্তকারী যুবক শরীফ বেপারিসহ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় অভিযান চলছে।
নগরকান্দার ইউএনও মো. কাফী বিন কাদির বলেন, এলাকায় বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
সূত্র – যুগান্তর
