বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর শুধু পরিবেশগত বিষয় নয়, এটি এক ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকটের রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ার ফলে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এতে কোটি কোটি মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়েছেন।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন প্লাবনের কারণে লবণাক্ত পানি মিষ্টি পানির স্তরে অনুপ্রবেশ করছে। এতে পরিবর্তিত হচ্ছে পানির রসায়ন, বিশেষ করে অক্সিজেনের ঘনত্ব, পিএইচ ও তাপমাত্রা, যা মাটির গঠনকে প্রভাবিত করে। ফলে পলিমাটি থেকে নির্গত হচ্ছে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক।
পরিবেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রীষ্মকালীন ঘূর্ণিঝড়ের ফলে প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলবর্তী অঞ্চলে আঘাত হানে, যা মাটির উপরিভাগে লবণাক্ততা বাড়ায় এবং ভূগর্ভস্থ পানির গুণমানকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ এখনো ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে থাকলেও, এই পানির প্রায় ৪৯ শতাংশেই আর্সেনিকের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্ধারিত ১০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি লিটার মাত্রার চেয়ে বেশি। দীর্ঘদিন এমন পানি পান করলে ত্বক, যকৃত, ফুসফুস এবং মূত্রাশয়ের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
১৯৭০-এর দশকে, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় দেশে প্রায় এক কোটি নলকূপ স্থাপন করা হয়। সেই সময় এটি ছিল পানীয় জলের সংকট সমাধানের অন্যতম কার্যকর উদ্যোগ। কিন্তু আজ, সেই নলকূপের অনেকগুলো থেকেই আসছে বিষাক্ত পানি।
শুধু নলকূপের পানি পান করেই মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত হচ্ছে না, বরং দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ ৪৩টি জেলার মানুষ বোরো ধানের চালের ভাত খেয়েও ধীরে ধীরে এই বিষাক্ত উপাদানের শিকার হচ্ছে। এসব ধানের চাল সারা দেশের মানুষ খাচ্ছে, ফলে আর্সেনিকজনিত মারাত্মক রোগ নীরবে ছড়িয়ে পড়ছে। কারণ, বোরো ধান চাষে ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার করা হয়, যা অনেক জায়গায় আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত। সেই পানি দিয়ে সেচ দেওয়া ফসলেও স্বাভাবিকভাবেই আর্সেনিকের প্রভাব পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্সেনিকযুক্ত পানি দীর্ঘদিন পান করলে তা কেবল ক্যান্সার নয়, গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করে। এটি এক নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করছে। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিকে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং অবিলম্বে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন।