সুমন সাহা :: এই গ্রীষ্মে বিশ্বজুড়ে বিরাজ করছে চরম আবহাওয়া। ইউরোপের অনেক জায়গায় তাপমাত্রা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গ্রিস ও স্পেনে দাবানল বিশাল বনভূমি ধ্বংস করেছে। ভারতে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যা হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। উত্তর আমেরিকায় ঘূর্ণিঝড় প্রায়শই স্থলভাগে আঘাত হানছে এবং বিভিন্ন অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বস্তুত, জাতিসংঘের জলবায়ু প্রতিবেদন দীর্ঘদিন ধরেই এই আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে যে, বিশ্বব্যাপী দ্রুতগতিতে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং এর প্রতিক্রিয়া কৃষি, অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষিক্ষেত্রই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন ফসল উত্পাদনের ওপর প্রভাব ফেলে। উচ্চ তাপমাত্রা, খরা, অথবা ভারী বৃষ্টিপাত এবং বন্যা ফসলের ফলন হ্রাস করে। ২০২৪ সালে, উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ইউরোপে গমের উত্পাদন তীব্রভাবে হ্রাস পায় এবং অস্ট্রেলিয়ার গমের উত্পাদন ৩৪ শতাংশ কমে যায়। ভারত একটি প্রধান চাল রপ্তানিকারক দেশ। অথচ বন্যার কারণে জরুরিভাবে চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করে দেশটি। এর ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দামে তীব্র ওঠানামা দেখা দেয়। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে কীটপতঙ্গ ও রোগ-বালাই বাড়ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি তৈরি করছে।
অর্থনৈতিক ক্ষতিও বিস্ময়কর। চরম আবহাওয়া কেবল রাস্তাঘাট, সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস করেনি, বরং অনেক শিল্পের ওপরও প্রচণ্ড আঘাত হানছে। কৃষি উত্পাদন হ্রাসের কারণে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের খরচ বেড়ে গেছে এবং খারাপ আবহাওয়ার কারণে কোনো কোনো স্থানে পর্যটন স্থবির হয়ে পড়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, চরম আবহাওয়ার কারণে বিশ্ব প্রতিবছর ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও ভারী অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে।
জনস্বাস্থ্যও সংকটে পড়েছে। বন্যা পানির উত্স দূষিত করে এবং কলেরা ও টাইফয়েডসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগের ঝুঁকি নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। উচ্চ তাপমাত্রায় হৃদরোগ ও হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে মশা ও অন্যান্য বাহক তাদের আবাসস্থল প্রসারিত করে এবং ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার ঘটে।
সমগ্র মানবজাতির ভাগ্য নিয়ে উদ্বেগজনক এই সংকটের মুখে, বিশ্বব্যাপী সমন্বিত কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে হবে। যদিও প্যারিস চুক্তিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তবুও এর বাস্তবায়নে অনেক অসুবিধা রয়েছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে কার্বন নির্গমন হ্রাসের দায়িত্ব এবং আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার বিভাজন নিয়ে দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে। কোনো কোনো দেশ জীবাশ্ম শক্তির ওপর নির্ভর করে এবং শক্তি রূপান্তরের জন্য তাদের প্রেরণার অভাব রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে, চীন কেবল নিজস্ব পরিবেশ সুরক্ষা অনুশীলনের মাধ্যমেই একটি উদাহরণ প্রদান করে না, বরং তিনটি বৈশ্বিক উদ্যোগের মাধ্যমে একটি প্রধান দেশ হিসেবে তার দায়িত্বও পালন করে। বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগের অধীনে, চীন সম্পূর্ণরূপে উন্নয়নের ওপর মনোনিবেশ করে, সক্রিয়ভাবে অন্যান্য দেশের সাথে উন্নয়নের সুযোগ ও অভিজ্ঞতা ভাগ করে, এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘের ‘এজেন্ডা ২০৩০’ বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সবুজ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকে উত্সাহিত করে, পরিষ্কার শক্তি প্রযুক্তির ভাগাভাগি জোরদার করে, এবং দেশগুলোর চরম আবহাওয়া মোকাবিলার ক্ষমতা উন্নয়নে সহায়তা করে।
বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগে চীন মানবজাতির একটি অভিন্ন নিরাপদ সমাজ গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়। চরম আবহাওয়ার কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা সমস্যা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে চীন।
বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগ বিশ্ব সভ্যতার বৈচিত্র্যকে সম্মান করে এবং যৌথভাবে সমগ্র মানবজাতির সাধারণ মূল্যবোধকে প্রচার করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে বিনিময় ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে, দুর্যোগ প্রতিরোধ ও প্রশমন এবং পরিবেশগত সুরক্ষায় একে অপরের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে, এবং বিশ্বব্যাপী ঐকমত্য তৈরি করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন সমগ্র মানবজাতির অভিন্ন শত্রু এবং কোনো দেশই এ থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। উন্নত দেশগুলো যখন তাদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, উন্নয়নশীল দেশগুলো সবুজ রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে, এবং চীনের তিনটি প্রধান বৈশ্বিক উদ্যোগের মতো ধারণা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, তখনই জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে। পৃথিবী রক্ষা করা মানে আমাদের ভবিষ্যতকে রক্ষা করা। এর জন্য সমগ্র মানবজাতির একসাথে কাজ করতে হবে।