অনলাইন ডেস্কঃ আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা জটিলতায় তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। এ বছরের জুলাই শুরু থেকে ই পাসপোর্ট চালুর কথা থাকলেও তা হয়ে ওঠেনি। সবশেষ গত ২৩ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংসদে বাজেট আলোচনায় বলেন, জুলাই মাসের শেষ নাগাদ ই-পাসপোর্ট ও ই-গেইটের কার্যক্রম দৃশ্যমান হবে ।
সোমবার (৮ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত ই পাসপোর্ট সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জুলাইয়ের শেষেও ই পাসপোর্ট বিতরণ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আকাশ, জল ও স্থল বন্দরে ই-গেট স্থাপনের কাজ এখানো শেষ হয়নি। নির্ধারণ হয়নি পাসপোর্ট ফি। এমনকি কিভাবে এর ব্যবহার করা হবে তার প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি ইমেগ্রেশন পুলিশকে। চূড়ান্ত হয়নি কোনো নীতিমালাও।
এটা কবে নাগাদ চালু হবে সুনির্দিষ্ট করে সেটিও কেউ বলতে পারছেন না। তবে পাসপোর্ট অধিদফতরের একটি সূত্র জানিয়েছেন, আগস্টের শেষ নাগাদ ই পাসপোর্ট জনগণের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হবে।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মো. সোহায়েল হোসেন খান সোমবার (৮ জুলাই) বলেন, ই পাসপোর্ট চালুর জন্য প্রয়োজনীয় সকল কাজ শেষ করা হচ্ছে। চালুর দিনক্ষণ বলতে পারছি না। তবে চালু হলেই সবাই জানতে পারবে। আমাদের সব রকমের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগ) মোহাম্মদ আজহারুল হক বলেন, ই-পাসপোর্ট জুলাইয়ের মধ্যে চালু করার লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি। এর মধ্যে চালু করতে না পারলে আগস্ট মাসে দিতে পারব। আমাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই।
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ সুপার (ইমিগ্রেশন) শাহারিয়ার আলম সোমবার (৮ জুলাই) বলেন, বিমানবন্দরে নতুন করে দুটি ই গেট বসানোর কাজ চলছে। তবে কালো তালিকাভূক্ত ব্যক্তি, জাল পাসপোর্ট ও ভিসাধারী ব্যক্তি এবং মানবপাচার ঠেকাতে সেখানে করণীয় বা কোনো নির্দেশনা আসেনি। তৈরি হয়নি নীতিমালা। অল্পসময়ের মধ্যে এর কার্যক্রম হয়তো চালু হবে বলে আশা করছি।
পাসপোর্ট অধিদফতর থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে চার হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা খরচে ই পাসপোর্ট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। গত বছরের জুলাই থেকে জার্মানির ভেরিভোজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান এর কাজ করছে। দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও দুটি স্থলবন্দরে স্বয়ংক্রিয় সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বা ই-গেট স্থাপনের কথা থাকলেও তা এখনো হয়ে ওঠেনি। এসব বন্দরে ৫০টি ই-গেট দিয়ে ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্টধারীদের সহজেই ইমিগ্রেশন পার হওয়ার কথা। ৫০টি ই-গেটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বসানো হবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ভিআইপি, ভিভিআইপি যাত্রী ছাড়াও শুধু ২৪টি গেট সাধারণ যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য বসানো হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৩১ মার্চ মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. শহিদুজ্জামানের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বেনাপোল ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ৫০টি ই-গেট স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জার্মানির প্রতিষ্ঠান থেকে ই-গেট আনা হচ্ছে। শিগগিরই এগুলো দেশে পৌঁছাবে। এরই মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুটি গেট বসানোর কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
সূত্র আরো জানায়, ই-পাসপোর্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে জার্মানির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পাসপোর্টের ইলেক্ট্রনিক চিপে ১০ আঙুলের ছাপ থাকার কথা। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী জার্মান কোম্পানি মাত্র দুটি আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ করতে চাচ্ছে। ‘মাত্র দুই আঙুলের ছাপে ভবিষ্যতে জালিয়াতি হতে পারে, তাই এ প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে না পাসপোর্ট অধিদফতর। এ নিয়ে জার্মান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক ও চিঠি চালাচালি হয়েছে। বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি। এটাও ই-পাসপোর্ট চালু না হওয়ার অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে।
এদিকে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ পর্যায়ে থাকলেও এখনো এর ফি চূড়ান্ত করা হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ে ই-পাসপোর্টের ফি-র প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তারা ফি নির্ধারণ করবে। উদ্বোধনের পর সেট-আপের জন্য আরও কিছুদিন সময় লাগবে। পুরোপুরি প্রস্তুত হলে দিনে ২৫ হাজার পাসপোর্ট প্রিন্ট করা সম্ভব হবে। ই-পাসপোর্টের যুগে নাগরিকরা চাইলে এমআরপিও করতে পারবেন, সে ব্যবস্থাও থাকবে। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ন্যূনতম ছয় হাজার টাকায় একজন নাগরিক ২১ কার্যদিবসের মধ্যে পাসপোর্ট পাবেন। এছাড়াও, সাত দিনের এক্সপ্রেস ডেলিভারির জন্য ১২ হাজার এবং একদিনের সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারির জন্য ১৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ১১৯টি দেশের নাগরিক ই-পাসপোর্ট ব্যবহার করছে। ই-পাসপোর্ট চালু হলে ১২০তম দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম লেখা হবে। ই-পাসপোর্ট ই-গেটের একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখার সঙ্গে সঙ্গে বাহকের পরিচয় নিশ্চিত করবে। নির্দিষ্ট নিয়মে দাঁড়ালে ক্যামেরা ছবি তুলে নেবে। থাকবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের ব্যবস্থাও। সব ঠিক থাকলে দ্রততম সময়ের মধ্যেই ভ্রমণকারী ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যেতে পারবেন। ই-গেটে কোনো তথ্যবিভ্রাট ঘটলেই লালবাতি জ্বলে উঠবে। তখন সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সঠিকভাবে ই-পাসপোর্ট ব্যবহারে সহযোগিতা করবেন।
অত্যাধুনিক এই ই-পাসপোর্ট একটি বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট, যাতে একটি এমবেডেড ইলেক্ট্রনিক মাইক্রোপ্রসেসর (মোবাইলের মেমোরি কার্ডের মতো) চিপ থাকবে। এই মাইক্রোপ্রসেসর চিপে পাসপোর্টধারীর বায়োগ্রাফিক ও বায়োমেট্রিক (ছবি, আঙুলের ছাপ ও চোখের মণি) তথ্য সংরক্ষণ করা হবে, যাতে পাসপোর্টধারীর পরিচয়ের সত্যতা থাকে। ই-পাসপোর্টে মোট ৩৮ ধরনের নিরাপত্তা ফিচার থাকবে। বর্তমানে এমআরপি ডাটাবেজে যেসব তথ্য আছে, তা ই-পাসপোর্টে স্থানান্তর করা হবে।