ছাত্র-জনতা যেভাবে স্বৈরাচারকে বিদায় করেছে ঠিক সেভাবে জুলুমতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে দেশের প্রতিটি সেক্টরে ইনসাফ কায়েম করার জন্য ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মুঞ্জুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ছাত্রশিবিরের প্রত্যেকটি নেতাকর্মীকে নৈতিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ক্যাস্পাসগুলোতে তরুণ ছাত্রসমাজকে মাদক-সন্ত্রাস থেকে দূরে রেখে ইসলামের সুমহান আদর্শের পরিচয় তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি ক্যাম্পাসগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেকটি জনশক্তিকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রশিবিরের জনশক্তিরা নিজেদের গড়ে তুলবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষদের ভালোবাসতে হবে এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে। ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠার পর থেকে সকল জুলুম-বাধা আদর্শিক শক্তি দিয়ে প্রতিহত করেছে, তাই দেশের যে কোন সংকট ও ক্রান্তিকালে ছাত্রশিবির সর্বশক্তি দিয়ে সব ষড়যন্ত্রের দাঁত ভাঙা জবাব দিবে।’ সোমবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে খুলনা প্রেসক্লাবের ব্যাংকুয়েট হলে ইসলামী ছাত্রশিবিরের খুলনা অঞ্চলের সাথী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন ।
কেন্দ্রীয় ছাত্রকল্যাণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুনের সভাপতিত্বে ও খুলনা মহানগরী সভাপতি আরাফাত হোসেন মিলনের পরিচালনায় সাথী সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি ও খুলনা অঞ্চলের পরিচালক মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য ও খুলনা মহানগরী আমীর অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান। সমাবেশে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় তথ্য সম্পাদক গালিব আব্দুল্লাহ, খুলনা মহানগর সেক্রেটারি এস এম নূরুল্লাহ, সাতক্ষীরা শহর সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাতক্ষীরা জেলা সভাপতি ইমামুল হোসেন, খুলনা জেলা উত্তর সভাপতি হাফেজ বেলাল হোসাইন রিয়াদ, জেলা দক্ষিণ সভাপতি আবু জার গিফারী, বাগেরহাট জেলা সভাপতি নাজমুল হাসান সাইফ প্রমুখ। খুলনা মহানগরী, খুলনা জেলা, সাতক্ষীরা জেলা ও বাগেরহাট জেলার দুই সহ¯্রাধিক সাথী উপস্থিত ছিলেন। পরে একই স্থানে সদস্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
কেন্দ্রীয় সভাপতি আরও বলেন, শুকরিয়া আদায় করছি সেই মহান রবের কাছে যিনি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আজ জালিম শাসকের অবসান ঘটিয়েছেন। আমরা জুলুম নির্যাতন থেকে মুক্ত কিন্তু ষড়যন্ত্র লেগেই আছে। স্বৈরাচারী সরকার প্রশাসনকে তার রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করেছে। পুলিশ বাহিনীকে দলীয়করণ করে ফেলেছিল। কিন্তু এই চিত্র আজ আর নাই। আওয়ামী সরকার শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসন সব জায়গা ধ্বংস করে ফেলেছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও এ জাতির জন্য কোন স্থায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। ভাই, সন্তান ও যুবকদের ধ্বংস করা হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতির কোন নীতিমালা নেই। ভারতের সংস্কৃতি নীতিমালাকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
ছাত্রশিবিরের সাথীদের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, ব্যক্তি হিসেবে আরো উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর আমাদের দায়িত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা আমাদের চরিত্রের মডেল হিসেবে মোহাম্মদ (সা.) ও ইউসুফ (আ.) এর কাছ থেকে শিখেছি। আমাদের কোন কোন জায়গা থেকে মডেল নেয়া না। কুরআন ও হাদিস আমাদের দিক নির্দেশনা। কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের দেখে কেউ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির করেনা। যারা সাথী বা স্থানীয় দায়িত্বশীল তাদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়। হাসিনার জুলুম যেভাবে তছনছ করে দিয়েছে এই ছাত্র সমাজ। ঠিক সেইভাবে কেউ জুলুম অত্যাচার করতে আসলে তাকেও তছনছ করে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
বিজয়ের পর রাসূল (সা.) বিনয় থাকতেন ও ইস্তেগফার পাঠ করতেন। এ জন্য বেশী বেশী করে আমরা আল্লাহর প্রশংসা ও ইস্তেগফার পাঠ করবো।
মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষাঙ্গন আজ সন্ত্রাসী মুক্ত তাই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সব শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সেরা পরিবেশ তৈরি করবে। আমাদের সাথে কোন সংগঠনের তুলনা করা হয় না, আর হবেও না। কারণ, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির আল্লাহর সেরা উপহার। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির আল্লাহর কাছাকাছি যাওডার সুযোগ তৈরি করে দেয়।
তিনি বলেন, আমরা কখনো বেপরোয়া নয়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয়ের পরে আমরা আরো সচেতন থাকবো। ছাত্র আন্দোলনে আমাদের ভূমিকা রয়েছে তার উদাহরণ রাজশাহী মহানগরী ছাত্র শিবিরের সভাপতি আলী রায়হানের শাহাদাত বরণ। আমারা কতশত পথ মাড়িয়েছে জানিনা। কিন্তু সামনে আরো যতদূর হোক যেতে হবে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির মৃত্যুর ভয়ে পালিয়ে যায় না। শাহাদাতের বাসনা থাকে তারা পালায় না। যেখানে ছাত্রশিবিরের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি যিনি ফাঁসির মঞ্চে হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছেন। সেরা সাহসী বীর হিসেবে আমরা স্মরণীয় হয়ে থাকবো।
তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরে আমাদের কিছু কাজ রয়েছে : ১। কোন শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী থাকবে না। শিক্ষা বান্ধব পরিবেশ তৈরি করাই আমাদের প্রত্যয়। ২। আগের সকল ঘাটতি শক্তি, মেধা, মান ও যোগ্যতা দিয়ে পুষিয়ে দিব। ৩। সকাল থেকে সন্ধ্যা এর ভিতর সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দিনের পথে থাকবো। ৪। প্রতিটি ছাত্রের কাছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের দাওয়াত পৌঁছে যাবে।
কেন্দ্রীয় সভাপতি বলেন, বিগত সময়ে স্বৈরাচারী সরকার কাছে কুরআন হাদিস ইসলামিক বই পাওয়ার পর জঙ্গি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এখন দেখিয়ে দিতে চাই এই বইগুলোই আমাদের শক্তি। যারা এ সব করেছে তারাই এখন লাঞ্ছিত অপমানিত। আমরা যেখানে ফাসের মঞ্চে হাসতে হাসতে ি য়েছি। তোমরা সেখানেই বাঁচার জন্য ছুটছো বিদেশে আর পালিয়ে বেড়াচ্ছো।
তিনি দ্বীনের সুমহান দাওয়াত কিভাবে দিতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, শহীদ আব্দুল মালেক ভাই আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথীদের সকল ক্ষেত্রে যৌক্তিক জবাব দিতে হবে। অযৌক্তিক কোন কথা বলা যাবে না। গোজামিলের আশ্রয় নেওয়া যাবে না। স্পষ্ট কথা বলতে হবে।
তিনি বলেন, এই জাতি কি চায়। এই জেনারেশনকে স্টাডি করে, সেই অনুযায়ী ইসলামের সুমহান দাওয়াত তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কোয়ালিটি সম্পূর্ণ কাজ বা কর্মসূচি করতে হবে। সাংগঠনিক সকল পর্যায়ের কাজের মাধ্যমে দেখিয়ে দিতে হবে, এটাই সেরা ছাত্র সংগঠন। প্রতিটি ক্যাম্পাসে আমাদের ভাইদের রক্তের কথা বলে। প্রতিটি ক্যাম্পাসে আমাদের আহ্বান পৌঁছে দিতে হবে। আমাদের আহবান অন্যদের মতো হবে না। মন্দের জবাব ভালো দিয়ে হবে ইনশাআল্লাহ। ক্যাম্পাসে কোন বৈষম্য থাকবে না। জাতি আসলে কি চাই আমরা তা উপহার দিতে চাই। তিনি আরও বলেন, শেষ রাতে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে। আর সকাল হলে দাওয়াতি ময়দানে কাজ করতে হবে। বৈষম বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসকে মনে রাখতে হবে। এ আন্দোলনে কত রক্ত, কত লাশ মর্গে দেখেছি। পরিচয়হীন লাশ। এই ইতিহাস জাতিকে জানাতে হবে। ৪৭, ৫২, ৭১ সর্বশেষ ২৪ সব ইতিহাসকে ধারণ করে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। আমরা কখনো উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসবাদে জড়িত নই আর থাকবো না। কিন্তু যারা এগুলো করবে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান হবে কঠোর।
তিনি বলেন, আওয়ামী সরকারের আমলে ছিল অশ্লীলতা আর অশ্লীলতা। এমন শিক্ষা ব্যবস্থা এ জাতি কখনো চায়নি। শিক্ষাব্যবস্থার নৈতিকতার কোন বালাই ছিল না। প্রতিটি মসজিদ মক্তবে পরিণত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সব সময় তাদের পাশে থাকবে। এই জাতিকে নেতৃত্ব দিতে যোগ্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। সাথীরা হবে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আনুগত্য ও সততা সম্পন্ন। সকল বাধাই, আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট। যাদের সাথে আল্লাহ আছে, অপশক্তি কখনো তাদের পরাজিত করতে পারে না।
মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক বলেন, আগে আমরা নিয়মিত কার্যক্রম করতে পারতাম না। এটা আল্লাহর রহমত। দেশ এবং জাতিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ছাত্র-জনতার যে আন্দোলন তা অবিস্মরণীয়। স্বৈরাচার হাসিনা বলেছিল আদালতের বিষয়ে মাঠে করে লাভ নাই। ওবায়দুল কাদের বলেছিল আমার ছাত্রলীগ ছাত্রদের মোকাবেলা করবে। ছাত্রদের দাবিকে ছোট করে দেখা হয়েছিল। কিন্তু দাবি ছিল যৌক্তিক। এত এত বৈষম্য যা ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি ছিল। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকার তা ভিন্ন খাতে নিয়েছিল। আমার মনে হয় ছাত্রদের দাবি মেনে নিলে সরকারকে আর পালাতে হতো না। কিন্তু স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ভুলেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। তিনি বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আহতদের আশু সুস্থতা কামনা করি। বৈষম্য ছাত্র সংগঠনের কৃতিত্ব সব তাদের।
অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান বলেন, আপনারা জানেন বিপ্লবের একটি প্রতি বিপ্লব থাকে। আপনারা দেখেছেন আওয়ামী লীগ সরকার অনেকবার অনেকভাবে ফিরে এসেছে। এ গণঅভ্যুত্থানকে নাস্যাৎ করার জন্য শেষ পর্যন্ত আনসার হয়েও ছাত্রলীগ ফিরে এসেছিল কিন্তু ছাত্র-জনতা তাদের সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের চূড়ান্ত বিজয় হবে সেইদিন, যেদিন কালেমার পতাকা পথ পথ করে উঠবে। সকল সেক্টরে যেতে আমাদের জ্ঞানী, মানে, যোগ্যতায় সবদিক থেকে যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। আমি বলতে চাই ইসলামের জন্য খুলনা অঞ্চল সব সময়ই উর্বর অঞ্চল ছিল। আমাদের সেই অঞ্চলকে আবারো ইসলামী আন্দোলনের জন্য ঘাটিতে পরিণত করতে হবে।