
২০২৪ সালের আগস্ট মাসের পর খুলনার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, তবে তা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে এসেছে এমনটা বলা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়েও খুন, গোলাগুলি, ধর্ষণ, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়েছে প্রচণ্ড আকারে। ঐতিহাসিকভাবে খুলনাকে ‘শান্তির শহর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধ বৃদ্ধির কারণে এই পরিচিতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। খুলনার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ স্থানীয় নাগরিকরা প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন।
এখন খুলনায় প্রতিদিন গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে শহর। আবার কোথাও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে লুটিয়ে পড়ছে মানুষ। খুলনার স্থানীয় পত্রপত্রিকায় নিয়মিত চোখ রাখলে দেখা যায় ভয়ানক ভয়ানক শিরোনাম। শুধু স্থানীয় পত্রিকা নয়, অনেক হত্যাকাণ্ড এতটাই বীভৎস হয় যে তা জাতীয় পত্রিকার লিড নিউজে পরিণত হয়।
পুলিশের তথ্যমতে, গত দেড় মাসে খুলনা মহানগর ও জেলায় ২২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। রহস্যজনক মৃত্যুর পর মরদেহ উদ্ধার হয়েছে আরও ৯ জনের। এছাড়া গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। মাদক ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক কোন্দল কিংবা পারিবারিক বিরোধে ঘটছে এসব নৃশংসতা।
খুলনার মানুষ যে কতটা অনিরাপদ, তা এই ঘটনাগুলোর দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায়।
ঘটনা–১
গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, নগরের দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়া নিজ বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন তানভীর হাসান ওরফে শুভ (২৮)। রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাড়ির জানালা দিয়ে দুর্বৃত্তরা গুলি ছোড়ে ঘুমন্ত তানভীরের দিকে। ১ অক্টোবর বুধবার সকাল সাতটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
ঘটনা–২
১৭ অক্টোবর ২০২৫ দুপুর ২টা ১০ মিনিটে খুলনার ২ নম্বর কাস্টমস ঘাট এলাকায় বাড়ির ভেতরে ঢুকে সোহেলকে (২৮) গুলি করে দুর্বৃত্তরা। এর আগে গত ৩ আগস্ট একই স্থানে দুর্বৃত্তরা সোহেলকে লক্ষ্য করে গুলি করেছিল। তখনও তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন।
ঘটনা–৩
৫ অক্টোবর ২০২৫ ভাঙারি ব্যবসায়ী সবুজ খান স্থানীয় মাদক ও মামলাবাজ একটি গ্রুপের বিরুদ্ধে খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। এর চার দিনের মাথায় ৯ অক্টোবর প্রকাশ্যে সবুজ খানকে (৫৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
উপরে উল্লেখিত তিনটি ঘটনা নয়, এমন শত শত ঘটনা ঘটেছে খুলনায়। এখানে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে — তাহলে কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছুই করছে না?
কিছুই করছে না— ব্যাপারটা এমন নয়। তবে তারা যে ব্যর্থ, তাও তারা স্বীকার করতে নারাজ। ধরুন, আপনি কাজ শেষে রাত ১০টায় বাড়ি ফিরছেন। হঠাৎ হেলমেট পরা কিছু লোক মোটরসাইকেল নিয়ে আপনার পথ আটকাল, গুলিও চলে গেল! আপনার জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নন খুলনার পুলিশ।
২০২৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর খুলনার পুলিশ কমিশনার হিসেবে যোগদান করেছেন মো. জুলফিকার আলী হায়দার। এক বছর এক মাস খুলনায় তার কর্মদিবস অতিবাহিত হলেও তার সফলতা কোথায়? এমনটা নয় যে তিনি কাজ করছেন না! তিনি যোগদানের পর বেশ কিছু কুখ্যাত সন্ত্রাসী আটক করেছেন। আবার কিছু সন্ত্রাসী ধরার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন। তবে এতেই কি শহরে শান্তি ফেরে?
গত জুন মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দারের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করেন। তারা বলেন, খুলনায় দিন দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে। প্রায়ই হত্যাকাণ্ড ঘটছে; চোরাচালান, চাঁদাবাজি, মাদকের সিন্ডিকেট— কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। সব অপরাধের দায় নিয়ে পুলিশ কমিশনার পদত্যাগ না করলে লাগাতার কর্মসূচি দেওয়া হবে।
এর পর দেখা যায়, খুলনা বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও এই আন্দোলনে যোগ দেন। সে সময় পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘আমাদের দিয়ে কাজ আদায় করে নেন। কিন্তু দূরে সরিয়ে দেবেন না। আমি সরে গেলে আরেকজন তো আসবে, তাঁকে দিয়েও তো কাজ করাতে হবে। এখানে ৩ হাজার ১০০ পুলিশ সদস্য আছেন। তাঁদের মনোবল যদি ভেঙে যায়, সেটা খুলনাবাসী বা দেশের কারও জন্য ভালো হবে না। আমাকে আনফ্রেন্ড করবেন না, আমি আপনাদের শত্রু নই।’
তিনি একথা বললেও বেশ কিছু সাংবাদিক তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে, খুলনার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কাজ করতে গেলে যখন কমিশনারের বক্তব্যের প্রয়োজন হয়, তখন তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনি এড়িয়ে যান। তিনি সব মিডিয়া বা সব সাংবাদিককে বক্তব্য দেন না। এমনকি আমিও বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম তাঁর বক্তব্য নেওয়ার জন্য, কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি।
আমরা খুলনায় বসবাসরত সাধারণ মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে চাই। দিনে দিনে খুলনা তার জৌলুস হারাচ্ছে। এক সময়ের শিল্পনগরী এখন মৃতদের নগরে পরিণত হচ্ছে। আমার এই অশান্তি থেকে মুক্তি চাই। খুলনাকে বিশ্বের মডেল নগর হিসেবে দেখতে চায় খুলনাবাসী। খুলনার মানুষ চায়— আর কোনো মায়ের কোল যেন এভাবে দুর্বৃত্তের গুলিতে ঝাঁজরা না হয়। খুলনার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শুধু প্রশাসনের ব্যর্থতার ফল নয়; এটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ‘শান্তির শহর’ খুলনা হয়তো পুরোপুরি হারাবে তার পুরোনো মর্যাদা।
লেখা: মো. ছাব্বির ফকির, সাংবাদিক।


